পহেলা বৈশাখ উদযাপন নারীর জন্য কতটা নিরাপদ?
শারমিন আকতার:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গেটের ভেতরে ও বাইরে হাজার হাজার মানুষ। তার মাঝেই কিছু যুবক নববর্ষের উৎসবে আসা মেয়েদের পরনের কাপড় টেনে ছিড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটায়। ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় আক্রান্তু মেয়েদের চিৎকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশেষ দিনের অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষের ভিড়কে টার্গেট করে এরা। ২০১৪ সালে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান শেষেও ঘটে শ্লীলতাহানির ঘটনা।
২০১৫ সাল। বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েকজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। ভিড়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ একদল নারী লাঞ্ছনাকারী ঘটনাস্থলে কয়েকজন নারীর শাড়ি ধরে টান দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা এবারে প্রথম ঘটলো তা নয়। নববর্ষের সন্ধ্যায় নারীদের বিবস্ত্র করার ঘটনাটাও নিশ্চয় ভুলে যাননি।
এতকিছুর পরও কি থেমে আছে পহেলা বৈশাখ উদযাপন? আর কেউ না হোক রমরমা ব্যবসার এই সুযোগ কি ব্যবসায়ীরা হেলায় হারাতে চায়বে? ভীড়ের মাঝে চরম মজা লুটার আশায় যারা অপেক্ষায় থাকে তারাই বা কীভাবে এ সুযোগ নষ্ট করবে? প্রগতিবাদীদের গত কয়েকদিনের অনেক আবোল-তাবোল কথার রেশ ধরে বলতে চাই, যেহেতু পহেলা বৈশাখে নারীর নিরাপত্তা নেই তাহলে এ সমস্ত আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হোক। জানি তারা এ দাবি কখনও করবে না। তাহলে ভবিষ্যতে অন্য কোনোকিছু বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তোলার আগে কথাটি মাথায় রাখবেন। মাথা ব্যথা করলে নিশ্চয় মাথাটি কাটতে যাবেন না। বহুদিন হলো এ সমস্ত দুর্ঘটনার পর থেকে ভীড় ঠেলে রোদে পুড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে এ ক্যাচালে আর যাই না।
কথায় আছে, কোলাহলের মাঝেই মানুষ বড় নি:সঙ্গ। এই কুলাঙ্গারগুলো সে কথাটা বেশ ভালোই জানে। এই কোলাহলপূর্ণ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে গিয়ে কোনো নারীই এদের নিকৃষ্ট চাহনি আর অসংযত মাতাল হাতগুলো থেকে রেহায় পেয়েছে এমন কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এমন মাতাল হাওয়ায় রঙিন উচ্ছাসে কতটা অসহায় নারীরা তা কি কখনও কেউ ভেবে দেখেছে? ছোট ছোট মেয়েগুলো এই বিকৃতির শিকার হয় সর্বোচ্চ পরিমাণে! যা তারা কাউকে লজ্জায় বলতেও পারে না। ভেতরে ভেতরে শুরু হয় এক যুদ্ধ। এই ক্ষোভের আগুনে যারা পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়; তাদের থেকেই জন্ম হয় তসলিমা নাসরিনদের মতো নির্যাতিতা নারীদের। এখন তাদের সব ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হয়। তাই অযৌক্তিক-অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথায় তারা বলে থাকেন। তাদের সহানুভূতির সাথে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। কারণ তারা এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ফেলেছেন। যদিও তাদের আপাত দৃষ্টিতে সুস্থ মনে হয়।
আমরা বাংলা নতুন বছর উপলক্ষ্যে একটু অবাধ আনন্দে মেতে উঠতে চাই সবাই। কত রঙবাহারী কাপড় কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অথচ একবারও নিজেদের ঘরের মেয়েগুলোর নিরাপত্তার কথা ভাবি না। আমাদের মনে একটা বিষয়ই কাজ করে এত মানুষের ভীড়ে আমার মেয়ে-আমার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকবে। আপনি নিজ হাতে তাদের লাঞ্ছিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। মনে আছে বাঁধনের কথা? মনে আছে সেই মহিলাটির কথা যার বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সবার সামনে কী করা হয়েছিল? এখানে একটা দল হাজির হবে এসব কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর উদ্দেশ্যে। যেভাবেই হোক যেটুকু পরিমাণে হোক তারা তা করবেই। আরেক দল থাকবে যারা এর শিকার হবে। শেষ দলটি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবে। অথচ সবাই একটু আনন্দ হৈ হুল্লোর করার চিন্তা থেকে এ দিনগুলোতে একত্রিত হয়।
যারা এসব ঝামেলা থেকে সরে থাকতে চান তাদেরকে বলবো, নিজেরা পারিবারিকভাবে একত্র হয়ে হাসি-ঠাট্টা আর চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারেন। তাতে খাওয়াও হলো, নিরেট আনন্দও পেলেন। দিনশেষে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগও পেলেন। এতকিছুর পরও কোনো বাবা যদি তার মেয়েকে, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে ভীড়ের মাঝে ঐ অমানুষদের ফাঁদে ফেরতে চান তাহলে আর কিছুই বলার নেই। স্বেচ্ছা মরণে কাউকে দোষ দেওয়ার থাকবে না। অন্ধকার ঘরে তাদের এ দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভাগিদার হতেও কেউ আসবে না।